শহরের যান্ত্রিক জীবনের বাহিরে কিছুটা সময় কাটানোর জন্য খুব অল্প কিছুদিনের পরিকল্পনায় আমরা কয়জন চলে গেলাম বান্দরবনে। বান্দরবান ভ্রমণ ও স্মৃতিকথা ~ সেদিন ছিল 8 মার্চ জোসনা রাত। সারারাত বসে হইহুল্লোড় করে সকাল ছয়টায় গিয়ে পৌছালাম বান্দরবান শহরস্থ গিরি ছায়া রিসোর্টে। কিছুক্ষণ পরেই চান্দের গাড়ি দিয়ে প্রথম যাত্রা শুরু করেছিলাম নীলগিরির উদ্দেশ্যে। যতদূর যাচ্ছিল ততই মনে হচ্ছিল পাহাড় আর মেঘের দু’য়ে মিলে যেন এক অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি বান্দরবান। উঁচু-নিচু, সূরু, আকাবাকা রাস্তায় যতই সামনে এগিয়ে যাচ্ছিল ততই সবার কণ্ঠধ্বনি হতে নিঃসৃত হচ্ছিল ওয়াও, জোস, জটিল ইত্যাদির মতো শব্দগুচ্ছ। মেঘ ও পাহাড়ের মিশ্রণের সেই অনাবিল সৌন্দর্য যদি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেখতেন তাহলে ঠিক বলে উঠতেন,
“এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি”
স্বপ্নীল নীলগিরি-
বান্দরবান শহর থেকে পাহাড়ে আঁকাবাঁকা রাস্তায় ৪৭ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে আমরা পৌঁছাতে হল স্বপ্নময় নীলগিরিতে। যেন মেঘ ও রোদের লুকোচুরি খেলা চলছে। রোদের তাপ্ততায় যখন চারপাশে তাকানো যাচ্ছিলো না কিন্তু মেঘ তার স্নিগ্ধতার পরশ বুলিয়ে দিচ্ছিল পরম মমতায়।
নীলগিরিতে পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই সবার ফটো সেশন শুরু হয়ে গেল সুউচ্চ পাহাড় হতে কাঠের বানানো হরেক রকম ডিজাইন রেলিং এর সাথে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন পোজ দিয়ে ছবি ও সেল্ফি তোলা।
সেখানকার রেস্তোরাঁয় ছিল মানসম্পন্ন খাবারের ব্যবস্থা। দুপুরের মোরগ-পোলাও খেয়ে আমরা সবাই আবার নীলগিরির মায়াজাল হতে বের হয় উল্টো পথে যাত্রা শুরু করলাম।
সুউচ্চ চিম্বুক-
নীলগিরি থেকে আমরা এসে পৌছালাম বাংলার দার্জিলিং খ্যাত সুউচ্চ চিম্বুক পাহাড়ে। সেখানকার উঁচু-নিচু আঁকাবাঁকা রাস্তা বেয়ে উপরে উঠতে খানিক পা ভেঙ্গে আসছিল। চিম্বুক পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে নিচের দিকে যতদূর চোখ যাচ্ছিল ততই সবুজের সমারোহে মনমুগ্ধ হচ্ছিলাম। আমাদের সেখানেও কিছুক্ষণের জন্য ছবি তুলে নিয়ে আবার যাত্রা শুরু করা হলো শৈলপ্রপাতের উদ্দেশ্যে।
প্রবাহমান শৈলপ্রপাত-
প্রকৃতি তার আপন সৌন্দর্য ঢেলে দিয়েছে শৈলপ্রপাতের মাধ্যমে। চিম্বুক থেকে পনের বিশ মিনিট পর আমরা এসে পৌছালাম শৈলপ্রপাতে। সেখানকার হিম শীতল পানিতে সবাই পা ভিজিয়ে নিলাম প্রকৃতির সৌন্দর্য প্রবাহমান ঝর্ণায়।
পাহাড়ি উপজাতিদের কৃষ্টি সাংস্কৃতিক জীবনযাত্রার বর্ণাঢ্যতা মুগ্ধ করেছে আমাদের।
উপজাতিরা তাদের তৈরি করা তাঁতে বোনা কাপড় সহ মৌসুমী বিভিন্ন ফল-ফলাদি বিক্রি করে জীবিক নির্বাহ করে। শৈলপ্রপাত থেকে এসে সেদিনের মত ঘোরাঘুরি সেখানেই শেষ হয়েছিল
বৌদ্ধধর্মীয় স্বর্ণমন্দির-
দ্বিতীয় দিনের মতো আমাদের ভ্রমণ শুরু হয়েছে স্বর্ণমন্দিরের যাত্রার মাধ্যমে। প্রায় ১৬০০ ফুট উচ্চতায় পাহাড়ের চূড়ায় স্থাপত্যের অপূর্ব নিদর্শন বৌদ্ধ ধাতু স্বর্ণ জাদী। বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের কাছে এটি তীর্থ যাত্রা হলেও পর্যটকদের কাছে বেশ আকর্ষণীয়। যতদূর শুনেছিলাম ১২৩টি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে হয় সেখানে গিয়ে তাই দৃষ্টিগোচর হয়েছিল। নান্দনিক কারুকার্য খচিত স্বর্ণমন্দিরে অপূর্ব কিছু মুহূর্ত বেশ মন মুগ্ধ করেছিল আমাদের। যদিও সেখানকার মূর্তিগুলোর সাথে ফটোও ভিডিও করা নিষেধাজ্ঞা থাকায় তেমন ছবি তোলা হয়নি।
নীলাম্বরী নীলাচল-
স্বর্ণমন্দির থেকে বেরিয়ে প্রায় ৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত নীলাচল পর্যটন কেন্দ্র। সেখানকার দৃষ্টিনন্দন সিঁড়ি দিয়ে পায়ে হেঁটে উপরে উঠতে হয়েছিল। গোলঘর, কাচের টাওয়ার সহ ছোট ছোট খড়ের ঘরসহ কারুকার্য খচিত সিঁড়িগুলো বেশ সুন্দর ছিল। পাহাড় ও মেঘের অপরূপ সৌন্দর্য যেখান থেকে বেশ উপভোগ্য ছিল। আমি এবং আমরা সবাই খানিকক্ষণ প্রকৃতির অপার মাঝে হারিয়ে গিয়েছিলাম।
মেঘলা ও মেঘলা লেক-
নীলাচল থেকে ফিরে এসে আমরা প্রবেশ করলাম মেঘলা পর্যটন কেন্দ্রে। সেখানে দৃষ্টিগোচর করার মত হচ্ছে পাহাড় কেটে পাহাড়ে ওঠার সিঁড়ি এবং দুটি ঝুলন্ত সেতু। সেখানকার লেকের নীল স্বচ্ছ পানিতে রয়েছে স্পিডবোট চড়ার সুব্যবস্থা এবং বিনোদনের জন্য আরও রয়েছে কেবল কার, টুরিস্ট ট্রেন। এখানে পাহাড়ের চূড়ায় উপজাতিরা ছোট ছোট দোকানে তাদের ফলানো ডাব, আখের রস বিক্রি করে থাকে। তারপর সব সুন্দর মুহূর্ত পুঁজি করে আমাদের সবাইকে নিজ গন্তব্যে ফিরে আসতে হয়েছে।